চিলেকোঠার ভালবাসা
চিলেকোঠার ভালবাসা
.-- স্যার আপনি কি সিগারেট খান?
-- হ্যা,
-- কেন সিগারেট খান?
-- এখন খাওয়ার কোন নির্দিষ্ট কারণ
নেই। তবে যখন খাওয়া শিখেছিলাম
তখন একটা কারণ ছিলো!
-- কি কারণ?
-- সে অনেক কথা, বাদ দাও! গ্রামার
বইটা এদিকে দাও।
-- আগে বলেন প্লিজ, শুনবো। প্লিজ
বলেন?
-- থাক এসব কথা,
-- না আপনাকে আজ বলতেই হবে। আজ
না শোনা পর্যন্ত কিছুতেই আমি এই
টেবিল থেকে উঠবো না। আর কোনো
বইও পড়বো না!
-- কি আশ্চর্য! সেসব কথা শুনে তোমার
কি হবে?
-- প্রয়োজন আছে, বলেন প্লিজ?
.
অনেক খোশামোদ আর কথার
রেষারেষি চলার পর সিমিকে
(ছাত্রী) সব বলতে বাধ্য হইলাম।
-- শোন তাহলে, আজ থেকে প্রায় ৬ বছর
আগে আমি একটি মেয়েকে
ভালবাসতাম। সেই মেয়েটি আমাকে
কষ্ট দিয়েছিলো তাই তখন খাওয়া
শিখেছিলাম। এইবার বইটা দাও,
-- কিন্তু ভালবাসার সাথে সিগারেট
খাওয়ার কি সম্পর্ক স্যার? একটু বুঝিয়ে
বলেন? প্লিজ স্যার!
.
বুঝতে পারলাম এই মেয়েটির ঘারে
কৌতূহলের ভূত চেপেছে। তবে একে
সাতপাঁচ বোঝানো মুস্কিল। দেখতে
বোকা হলেও অনেক ট্যালেন্ট।
-- সে তুমি বুঝবেনা,
-- একটু বুঝিয়ে বললেই বুঝবো, প্লিজ
স্যার বলেন?
.
নাহ্! এইবার আর ধৈর্যের বাঁধ মানলো
না আমার। হাতের বইটা বন্ধ করে
সিগারেট খাওয়ার কারণটাই
বোঝানোর জন্য মনস্থির করলাম।
চড়াগলায় জিজ্ঞেস করলাম---
-- কি জানতে চাও বলো?
-- ভালবাসার সাথে সিগারেট
খাওয়ার কি সম্পর্ক?
-- শোন তাহলে আমি যে মেয়েটি-
কে ভালবাসতাম সে আমাকে কখনো
ভালবাসতো, কখনো অবহেলায় দূরে
সরিয়ে দিতো। যখন যেমন চাইতো- যা
চাইতো, আমি তার মতোই সবকিছু
করতাম। তবুও আমি তার মনের মতো হয়ে
উঠতে পারিনি। সেদিন খুব অবুঝ বোকা
ছিলাম বুঝলে! ওর যখন কোনকিছুর
প্রয়োজন হতো, আমি আমার সাধ্যের
মধ্যে থাকা সবজিনিস গুলোই ঠিক ওর
হাতে তুলে দিতাম। কিন্তুু মেয়েটি
যখন এডমিশন নিয়ে আমাদের এলাকা
থেকে বাইরে চলে গেল পড়াশোনার
জন্য। তখন থেকেই আমাদের ব্যবধান শুরু।
ধীরেধীরে দুজনের দূরত্ব বেড়েই
চলছিলো সেইসময়। আগে আমাকে যতটুকু
সময় দিতো, তখন সেই সময়টুকুও দেওয়া বন্ধ
করে দিলো। অথচও যেদিন শহরে চলে
গেল পড়াশোনা করার জন্য। সেদিন
আমার কাছেে কোন টাকা ছিলোনা
বলে নিজের সেলফোনটা বিক্রি
করে ওর হাতে টাকা দিয়ে
দিয়েছিলাম। অনেক বিশ্বাস করতাম
ওকে। আপন ভেবে নিজের মতোই শুধু
সবকিছু করে গেছি ওর জন্য। আর সে শেষ
অব্দি নিজেকে সরিয়ে নিয়েছে
চলে গেছে। তখনকার সেই সময়টা খুব
খারাপ কেটেছে আমার। বন্ধুদের
মধ্যে অনেকেই তখন সিগারেট খেতে।
তখন তাদেই আড্ডায় বসে দুএকটান
দিতে দিতে কবে যে অভ্যাস হয়ে
গেছে টের পাইনি।
-- স্যার একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?
যদি অনুমতি দেন!
-- হ্যা বলো?
-- সেই আপুটা আজ কোথায় আছে?
-- সে আজ প্রবাসে থাকে। বড়লোক এক
ছেলেকে বিয়ে করেছে। বিয়ের
কয়েকদিন পর তাকে সাথে নিয়ে
আমেরিকা চলে গেছে।
-- ওহ্! সরি স্যার, আপনাকে মনে হয় কষ্ট
দিলাম!
-- আরে না! এখন আর এসব বলে কষ্ট
লাগেনা। মানুষের জিজ্ঞাসার এমন
উত্তর দিতে দিতে এখন আর এসব বলে
কষ্ট লাগেনা।
-- স্যার আপনি অনেক বোকা মানুষ তাই
আপনাকে ঠকিয়েছে।
-- কি জানি! হয়তো,
-- আচ্ছা স্যার সিগারেট খেলে কি
হয়?
.
প্রশ্নটা শুনে মেজাজটা খিটখিটে
হয়ে গেল। কপালে ভাজ টেনে এনে
বললাম---
-- তুমি জানতে চেয়েছিলে
সিগারেট খাই কেন, উত্তর পেয়েছ?
-- হ্যা,
-- তাহলে এইবার চুপ করো, বইটা দাও।
.
ছাত্রী বইটা হাতে দিতে দিতেই
আবার জিজ্ঞেস করলো---
-- আচ্ছা স্যার, যারা সিগারেট খায়
তাদের সবাই কি এমন কষ্ট পেয়েছে?
-- কে কি কারণে খায় সেটা আমি
কিভাবে বলবো!
-- সিগারেট খাওয়া যে স্বাস্থ্যের
জন্যে ক্ষতিকর সেটাতো ভালো
করেই জানেন। জানেন না?
-- হুম,
-- তাহলে জেনে শুনেও কেন খান?
-- বিড়ালের গলায় কাঁটা বিধে না,
-- কিন্তু স্যার, বিড়ালের গলায় কাঁটা
না বিঁধলেও যে কাঁটা পেটে গেলে
বিড়ালের পাকস্থলী ফুটো হয়ে
যেতে পারে।
-- হ্যা,
.
বুঝতে পারলাম এর সাথে কথায় পেরে
উঠা, আর ৯০ তলা বিল্ডিং এর উপরে
লিফট ছাড়া উঠার মতোই কষ্টকর। তাই
নিজেই থেমে গেলাম। সকালবেলা
যে ফুরফুরে মনটা নিয়ে পড়াতে
এসেছিলাম, সেই মনটা এখন আর তেমন
নেই। অতীত মনে করাই কষ্টের। আর যার
অতীতেই কষ্ট লুকিয়ে আছে! তার জীবন
কষ্টে কষ্টে কষ্টক্লিষ্ট। আবার সবভুলে
সিমির কাছে সাজেশনটা চাইলাম।
সিমি প্রতিউত্তরে বললো---
-- স্যার আজ আর পড়বো না, আপনি বসেন
আমি চা দিয়ে পাঠাচ্ছি।
.
কথাটা বলেই সিমি অন্য রুমে চলে
গেল। খেয়াল করলাম সামনের
রুমটাতে টেলিভিশন ছেড়ে গিয়ে
সিমি বসলো। সামনাসামনি দরজা
থাকায় আরও লক্ষ্য করলাম সিমি একের
পর এক রিমোট দিয়ে চ্যানেল চেঞ্জ
করেই চলছে। অ্যান্টি (সিমির মা)
আমার জন্যে চা বিস্কিট নিয়ে
আসলো। আমি দেখেই তাকে সালাম
দিলাম। উনি জিজ্ঞেস করলো---
-- সিমি কোথায়,
-- সিমি তো পড়বেনা বলে ঐ রুমে
চলে গেল,
.
অ্যান্টি সিমিকে ডাকলো---
-- এই সিমি, সিমি
-- জ্বি মা?
-- ঐ রুমে কেন, তোর স্যার এসেছে।
-- আজ পড়বোনা মা! ম্যাথাটা ব্যাথা
করছে।
.
আমি মনেমনে বললাম, "বাচালের
মতো এতো বকবক করলে মাথাব্যথা
করারি কথা" অ্যান্টি সিমিকে
বললো---
-- পড়বিনা সেটা ফোন করে বলে
দিলেই তো পারতি, শুধুশুধু ওকে কষ্ট
করালি কেন?
.
আমি অ্যান্টিকে বললাম---
-- না না অ্যান্টি ঠিকাছে, আমার
কোন কষ্ট হয়নি।
-- ঠিকাছে বাবা, তুমি চা বিস্কিট
খেয়ে নাও নাস্তা হোক তারপর
খেয়ে চলে যেও,
-- না অ্যান্টি, তাহলে আমার ম্যাচের
খাবার নষ্ট হবে। আমি বরং এখন চা
খেয়ে উঠি।
-- ঠিকাছে বাবা চা খাও,
.
অ্যান্টি চলে গেল। আমি রুমে বসে চা
বিস্কিট খাচ্ছি আর ভাবছি। আজও
আবার মিথ্যে বলে ফেললাম।
আমারতো ম্যাচে প্রতিদিন সকালের
নাস্তা অফ দেওয়া। প্রত্যেকদিন এসে
এই বাসার চা বিস্কিটেই আমার
নাস্তা হয়ে যায়। আর সেই কথাটা
আমি ছাড়া কোন দ্বিতীয় ব্যক্তি
জানেনা।পড়াশোনার খরচ, ম্যাচের
ভাড়া দেওয়া, সেসব দিয়ে তিন
বেলা ভাত খাওয়াটা খুব কঠিন আমার
পক্ষে। তাই সকালের নাস্তাটা
কোনরকম চা বিস্কিটেই শেষ হয়। কখনো
এই বাসায় না এলে বাইরের একটা
সিঙ্গারা, অথবা একটা কেকে খেয়ে
শেষ হয় সকাল। আমি চা শেষ করে উঠে
দাঁড়ালাম। সিমিকে বলে চলে
আসলাম। বাসার গেইট পার হয়ে
রাস্তার পাশ ধরে হেটে বাসায়
যাচ্ছি। সিমির বাসা থেকে আমার
বাসায় ফিরতে প্রায় ১৫ মিনিট
লেগে যায়। যাওয়া আসায় আধাঘন্টা
সময় লাগে । হাটছি আমার ভাবছি,
আজও পড়ানোর টাকাটা দিলোনা।
চক্ষুলজ্জার ভয়ে চাইতেও পারলাম না।
মাসের ৫ তারিখ শেষ। ম্যাচে এখনো
টাকা দেওয়াই হলোনা। কারো
কাছে ধার চাইবো সেরকম কোনো
মানুষও নেই আমার এই শহরে । কোনকিছু
বুঝে উঠতে পারছি। পায়ের
জুতোজোড়ার দিকে তাকালে
নিজেকে বড় অসহায় মনে হয়। রাস্তায়
ছড়িয়ে থাকা ছোট ইটপাথরের খোয়া
গুলোও পায়ের নিচে পরলে এখন
বোঝা যায়। এইবার ছিঁড়লে এটাকে
আর সেলাই করা যাবেনা। দৃশ্যগুলো খুব
মনেপরছে, গতমাসে এই জুতোজোড়া
নিয়ে যখন এক চামারের কাছে নিয়ে
গেলাম। জুতার অবস্থা দেখে আমার
দিকে টানা দের মিনিট তাকিয়ে
ছিলো। আমিও বুঝতে পারছিলাম এই
জুতায় সেলাই দেওয়া কষ্ট হবে! কারণ
জুতোজোড়ার মাঝে সেলাই পরেনি
এমন জায়গা খুব কম আছে। তারপরের
মাসে আর চক্ষুলজ্জার ভয়ে চামারদের
কাছেও নিয়ে যেতে পারিনি।
নিজেই দোকান থেকে একটা ফলা আর
সুতা কিনে এনে সেলাই করে
নিয়েছিলাম। তবে এমাসে বোধহয়
একটা কিনতেই হবে। পিছন থেকে
রিকশা এসে আমার পাশ ঘেসে গিয়ে
একটু দূরে থামলো। তাকিয়ে দেখলাম
সিমি রিকশায় বসে আছে। আমি কিছু
বলার আগেই সিমি বললো---
-- স্যার রিকশায় উঠেন, আমি
আপনাদের ঐদিকেই যাচ্ছি।
-- না না থাক, আমি হেটে যেতে
পারবো।
.
আমার আপত্তিকর কথাটা শুনে
সিমিকে দেখে মনে হলো সিমির
দৃষ্টিভঙ্গি অন্যরকম হয়ে গেলে। ঠিক
তাই, একটু চড়া গলায় বললো---
-- উঠুন তো স্যার, কোন সমস্যা নেই।
.
আমি আর কিছুই বললাম না। সিমির
কথামতো রিকশায় উঠে বসলাম। চুপচাপ
বসে সামনের দিকে তাকিয়ে আছি
আর ভাবছি। না জানি একসাথে
এভাবে দেখে কে কি ভুলভাল বুঝে
ফেলে। আর সেটা হলে সিমিকে
পড়ানো আমার বন্ধ হয়ে যাবে। নতুন
স্টুডেন্ট খুঁজে পাওয়া এইসময় খুবিই কঠিন
হবে। নিজেকে তখন আমার পক্ষে
চালানো অনেকটা আরও বেশি কষ্টকর
হয়ে যাবে। সিমি বললো---
-- আজ মায়ের সাথে কথা বলেছেন?
-- না, আজ বলা হয়নি।
-- কেন?
-- ফোনে টাকা নেই, আর সময় পায়নি
ফেক্সিলোড দেওয়ার।
.
কথাটা বলেই ভাবলাম, এখানেও
মিথ্যে বলে ফেললাম! মূলত আমার
কাছে আজ চারদিন যাবত কোন টাকাই
নেই। চারদিন আগে ১০ টাকা ছিলো
তারমধ্য থেকে ৩ টাকা দিয়ে শেপ
হওয়ার জন্যে একটা ব্লেড
কিনেছিলাম। পকেটে মাত্র ৭ টাকা
আছে। আর এই ৭ টাকা দিয়েই আরও
কয়েকদিন চলতে হবে। ফেক্সিলোড
দেওয়ার টাকা পাবো কোথায়! কথা
বলতে বলতে রিকশা আমার ম্যাচের
সামনে চলে এলো। আমি রিকশা
থেকে নেমে পিছনে থেকে
ম্যানিব্যাগ বেড় করলাম ভাড়া
দেওয়ার জন্যে। সিমি বললো---
-- আরে করছেন কি! আপনাকে ভাড়া
দিতে হবেনা। এই মামা চলেন আপনি।
.
আমি আরও একবার বললাম---
-- দেই ভাড়া,
-- না আপনাকে ভাড়া দিতে হবেনা,
.
আমি আর কথা বাড়ালাম না। পকেটে
মাত্র ৭ টাকা তা দিয়ে ভাড়ার
অর্ধেকও হবেনা। তবুও কিছু না বললে
অসুন্দর দেখায়। তাই এই ছলচাতুরীর আশ্রয়
নিলাম। এখানেও মিথ্যে একটা দৃশ্য
ফুটিয়ে তুললাম নিজের মাঝে।
ক্লান্তি দেহের সমস্ত জায়গা জুড়ে
বিস্তৃত হয়ে গেছে। কষ্টে মানুষ ক্লান্ত
হয়েও চলতে পারে। কিন্তু মিথ্যা
বলতে বলতে যে ক্লান্তি নিজের
ভেতরে চলে আসে, সে ক্লান্তি
কাজের ক্লান্তির চেয়েও অধিক
ক্লান্তিকর। রুমে এসে ফ্যানটা ছেড়ে
ফ্লোরে বসে পরলাম। ভাবছি, কি
অভিনয়টাই না সিমির সাথে করলাম।
পাক্কা একটা অভিনেতা হয়ে গেছি
আমি। ভাবতেই কষ্টে হাসি পাচ্ছে।
নিজের সাথে নিজের অভিনয়
করাটা সাধারণ ব্যাপার নয়। আর আমি
প্রতিনিয়ত তাই করেই চলেছি। কখন যে
ফ্লোরেই ঘুমিয়ে পড়েছি টের
পাইনি। দুপুরে ম্যাচ ম্যানেজার
ছানাউল্লাহ ভাই এসে ঘুম ভাঙালো।
আমি ঘুম থেকে উঠে বসলাম।
ছানাউল্লাহ ভাই বললো---
-- ম্যাচের টাকা দিতে হবে। আজ পাঁচ
তারিখ।
-- ভাই আর দুইটা দিন সময় দেন আমাকে।
টিউশনির টাকা এখনো পায়নি ভাই।
পেলেই দিয়ে দেব।
-- দেখ ভাই, তুমিও এখানে স্টুডেন্ট।
আমরাও এখানে স্টুডেন্ট। সবাই টেনে
একমাসের খাবারের টাকা চালিয়ে
দেওয়া যায়। কিন্তু তোমার তো বুঝতে
হবে। আমাদেরও টাকা বাড়ি থেকে
হিসেব করে পাঠায়।
.
বুঝতে পারলাম অনেক অভিযোগ
তাদের মাঝেও চেপে গেছে।
-- ঠিকাছে ভাই, দেখি আমি
আগামীকাল টাকা দিয়ে দিবো যদি
দেয়।
.
ছানাউল্লাহ ভাই রুম থেকে চলে গেল।
আমি সেখানেই বসে রইলাম।
সানাউল্লাহ ভাই আমার রুম থেকে
বেড় হওয়ার পর তাকে পাশের রুমের
রায়হান জিজ্ঞেস করলো---
-- কি ভাই টাকা দিলো?
-- না, দুইদিন সময় নিয়েছে,
-- আগেই বলেছিলাম এমন অনেক সময়
দেখাবে! কবে একদিন দেখবেন সব
ঘুছিয়ে চলে যাবে। তার চেয়ে
ভালো ম্যাচ মেম্বার অব্যশক টু-লেট
ঝুলিয়ে দেন।
.
রুমের ভেতরে বসে সবকথাই শুনতে
পেলাম আমি। কথাটা খুব গায়ে এসে
লাগলো। জানি গরিবের কথা গায়ে
লাগাতে নেয়। তবুও খুব গায়ে লেগে
গেল। গরিব হলেও যে নিজের
আত্মসম্মানটুকু এখনো বিলীন হয়ে
যায়নি। তাই হয়তো গায়ে লাগে।
গোসল দিয়ে না-খেয়েই বেড়িয়ে
পরলাম। এমন কথাশোনার পরেও যে
ভেতরে একমুঠ খাবার যাবে সেই
শরীরটা আমার নয়। আশেপাশে ঘুরে
একটা পার্টটাইম কাজের সন্ধান করে
সারাটা বিকেল কাটিয়ে দিলাম।
কিন্তু দিন শেষে বুঝাতে পারলাম,
আমার জন্যে এখানে কোথাও কোনো
কাজও নেই। সত্যিই কিছু মানুষ এতোটাই
অসহায় যে, প্রকৃতির দেওয়া একটা
সজীব নিঃশ্বাস তাদের নেওয়ার
ভাগ্য হয়না। সন্ধ্যা বয়ে গেল, চোখের
কোনায় শেষ বেলায় দু'ফোঁটা জল এসে
গড়িয়ে পরলো। ভাবলাম এই মাসটা
থেকেই গ্রামে চলে যাবো। মায়ের
কথাও খুব মনে পরলে। অনেক কষ্ট পেলে
আমার মায়ের কথা খুব মনে পরে।
পাশের একটা ফেক্সিলোডের
দোকান থেকে মাকে ফোন দিলাম
একমিনিট কথা বলার জন্য---
-- হ্যালো মা,
-- কেমন আছিস বাবা?
-- ভালো, কি করো?
-- নামাজ পড়ে উঠলাম,
-- খেয়েছ কিছু?
-- হ্যা, তোর মামা এসেছিলো অনেক
বাজার করে দিয়ে গেছে। তুই কি
খেয়েছিস?
-- আচ্ছা মা রাখি, পরে কথা বলবো।
.
পকেটে যে ৭ টাকা ছিলো তারমধ্য
থেকে ২ টাকা ফোন বিল দিয়ে
দিলাম। মাকে যে কথাটা বলার
জন্যে ফোন দিলাম সেই কথাটাই বলা
হলোনা। বলতে চেয়েছিলাম, "এই মাস
শেষেই বাড়ি ফিরবো!" কিন্তু সেটা
বলতে পারলাম না। এরমাঝেও একটা
গল্প লুকিয়ে আছে। বাবা চলে
যাওয়ার পর, মাকে তার ভাইয়েরাই
(মামারা) সব খরচাদি দিয়ে দেয়। চাল,
ডাল, বাজার যা লাগে সব মাসে
মাসে এসে কিনে দিয়ে যায়। আমি
সেখানে গেলে অনেক বড়বোঝা হয়ে
যাবো। কি করবো কিছু বুঝে উঠতে
পারছিনা। রাস্তার পাশ ধরে হাটতে
লাগলাম। ভাবলাম ফোনটা বেঁচে
দিবো। সামনের মাস চলতে গেলে
এছাড়া আর কোন উপায় নেই। হাতের
ফোনটা ৬ হাজার বেঁচে দিলাম। ছোট
চাচ্চুর দেওয়া এই একটামাত্র উপহার
আমার কাছে ছিলো। আজ সেটাও
বিক্রি করে দিলাম। রাতে বাসায়
ফিরে ছানাউল্লাহ ভাইয়ের ম্যাচের
সকল পাওয়া মিটিয়ে দিলাম। আর
ছানাউল্লাহ ভাইকে বলে দিলাম,
সামনে মাসে সীট'টা ভাড়া দিয়ে
দিতে। রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে
পরলাম। সকালবেলা সিমিকে
পড়ানোর উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।
হাটছি আর ভাবছি, শহরটা বুঝি অনেক
নিষ্ঠুর হয়! আবার ভাবছি শহরের কি
দোষ! এই শহরের কোন দোষ নেই। দোষ
শহেরের মানুষের। এরা সবাই যার
মাথায় তেল আছে তার মাথায়ই তেল
দেয়। আর যার মাথায় তেল নেই তার
অবস্থা হয় আমার মতো। হাটতে হাটতে
সিমিদের বাসার সামনে চলে
এসেছি। রীতিমতো ভেতরে ঢুকে
সিমিকে নিয়ে পড়ার টেবিলে
বসলাম। ঘন্টা আধেক যেতেই কে যেন
কলিংবেল চাপলো। সিমি গিয়ে
দরজা খুলে দেখলো ওর কোনোএক
বান্ধবী এসেছে। আমাকে বললো---
-- স্যার আপনি বসেন? আমি চা
বিস্কিট দিয়ে পাঠাচ্ছি। আমার এক
বান্ধবী এসেছে একটু কথা বলেই
আসছি।
.
আমি কিছুই বললাম না। সিমি ওর
বান্ধবীকে সামনে দিয়ে অন্য রুমে
নিয়ে যাচ্ছিলো। তখন সিমির
বান্ধবী সিমিকে জিজ্ঞাস করলো---
-- কিরে তোর স্যারের কি খবর?
.
রুমে বসে এমন প্রশ্ন শুনে আমি তাদের
কথায় কানপাতলাম। সিমি বললো---
-- আর বলিস না! স্যারের মাঝে বিরহ
আছে।
-- মানে!
-- হ্যা ৬ বছর আগে রিলেশন ছিলো।
মেয়ে ঠকিয়ে চলে গেছে।
.
কথা শুনে আমি নিশ্চিত হইলাম আমার
কথাই তারা সেখানে বলাবলি করছে।
সিমির বান্ধবী বললো---
-- তাতে কি, এখনতো আর কেউ নেই!
বলে দে।
-- যে বোকাসোকা মানুষ, কিছু বললে
আবার সেটা যদি মাকে বলে দেয়!
-- ধূর! ওসব নিয়ে টেনশন করিসনা।
বোকা হলেও এতোটা বোকা হবেনা!
যা বলে দিয়ে আয়। আমি এই রুমে আছি।
-- তুই চল আমার সাথে।
-- আরে না, আমি গেলে লজ্জা
পাবে। তুই একাই যা, কিছু হলে তো
আমি আছিই।
.
আমার আর বুঝতে বাকি রইলোনা।
সিমি এই কয়েকদিনে আমাকে পছন্দ
করে ফেলেছে। ক্ষণেকবাদে সিমি
এসে রুমের দরজার সামনে দাঁড়িলো।
বললো---
-- স্যার আপনাকে একটা কথা বলবো,
.
আমি চায়ের কাপটাতে চুমুক দিয়ে
নিচে রেখে জানতে চাইলাম---
-- কি কথা?
.
সিমি কিছু না বলেই রুম থেকে
বেড়িয়ে চলে গেল। আমি ভাবলাম
সিমির এইসব কথা শোনার আগে
নিজের কথাটাই বলে দেই! তাতে
অনেক ভালো থাকবে। আমি নিজেই
সিমিকে ডাকলাম---
-- সিমি,
-- জ্বি স্যার?
-- এদিকে আসো,
.
সিমি ভয় ভয়ে বান্ধবীকে সাথে
নিয়ে এসে দরজার সামনে দাঁড়ালো।
জানিনা আমার এই ডাকে ওরা দুজনে
কি ভেবে নিয়েছে। আমি বললাম---
-- তোমাকে কিছু কথা বলার ছিলো,
.
সিমি কাঁপা কণ্ঠে বললো---
-- বলেন স্যার?
-- আমি সামনে মাসে গ্রামে চলে
যাবও, তুমি নতুন একজন প্রাইভেট
মাস্টার ঠিক করে নিও!
.
কথাটা শুনে ওরা একজন আরেকজনের
দিকে তাকালো। হয়তো ভাবছে আমি
সব জেনে গেছি সেই কারণে আর
পড়াবোনা। কিন্তু আসল ব্যাপারটা
তো আমি জানি।
-- কেন স্যার?
-- এখানে থাকা প্রব্লেম হচ্ছে আমার,
-- কিন্তু আমার সাজেশন তো এখনো
কমপ্লিট হয়নি,
-- এই মাসে যতদূর পারি করে দিয়ে
যাবো, তারপর যে নতুন স্যার আসবে
তার কাছে থেকে সব বুঝে নিও।
.
সিমি আর কিছু বললো না। আমি উঠে
দাঁড়ালাম। বললাম---
-- আজ বান্ধবী এসেছে, আজ আর পড়া
হবেনা। আমি যাই, তোমরা আড্ডা
দাও।
.
খেয়াল করলাম সিমির মুখটা অনেকটা
মলিন হয়ে গেছে। তবুও ভাল
অপ্রকাশিত ভাললাগার মলিনতা অল্প
দিনেই ঘুচিয়ে যাবে। কিন্তু প্রকাশিত
ভালোলাগার প্রত্যাখ্যান ঘোচাবার
নয়। দরজা চাপিয়ে দিয়ে আমি চলে
আসলাম। গেইট থেকে বেড় হবো এমন
সময় সিমির ডাক শুনে দাঁড়ালাম। ছুটে
এসে আমার হাতে একটা খাম দিয়ে
বললো---
-- আপনার গত মাসের টাকা আছে
এখানে।
.
কত আছে, কি আছে দেখলাম না আর।
খামটা হাতে নিয়ে মুচকি হেসে
চলে আসতে লাগলাম। সিমি বললো---
-- স্যার টাকাটা গুণে নেন,
-- প্রয়োজন নেই,
-- কেন? যদি কম হয়?
-- কম হলেও আমার, বেশি হলেও আমার।
.
সিমি আর কিছুই বললো না। চুপ হয়ে
সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো। আমি
খামটা হাতে নিয়েই রওনা দিলাম।
.
দেখতে দেখতে ১ টা মাস আজ শেষ
হয়ে গেল।
এরমাঝে একদিন পড়ানোর সময় সিমি
আমাকে জিজ্ঞেস করলো---
-- স্যার সত্যি করে বলেন তো, আপনি
কেন গ্রামে চলে যাচ্ছেন?
.
সেদিন আর মিথ্যে বলিনি। সিমিকে
সব খুলে বললাম---
-- আমার বাবা নেই! মা একলা
বাড়িতে থাকে। আমাদের এই মা
ছেলের সংসারে অর্থ আয় করার মতো
কেউ নেই। মাকে তার প্রতিমাসের
খাবার, খরচ সব আমার মামারা দিয়ে
যায়। মা ছেলে দুইজন মানুষকে তো
কেউ আর এমনি এমনি খাওয়াবে না।
লোকেও বলবে পড়াশোনা বাদ দিয়ে
কিছু একটা করতে। কিন্তু আমি
চেয়েছিলাম পড়াশোনা করবো
পাশাপাশি কাজ করবো, টিউশনি
করাবো। কিন্তু সেটা আর পারলাম না।
কলেজের টাকা, ম্যাচ ভাড়া খাওয়ার
টাকা, এগুলো দিয়ে এখানে থেকে
পড়াশোনা করা আমার পক্ষে সম্ভবনা।
তাই ভেবেছি একটা কাজ ঠিক করে
আবার ঢাকায় আসবো। আর তখন শুধু
পরীক্ষাটাই দিবো ক্লাস করা
হবেনা।
.
সিমি তখন সমস্ত ব্যাপারটা বুঝতে
পারলো। এরমাঝে অ্যান্টিকেও
একদিন বলে দিয়েছি চলে যাবো
গ্রামে। আজ সিমির পড়ানোর
শেষদিন। আজ আর কিছু পড়ালাম না।
বিদায়ের সময় হয়ে এসেছে, অ্যান্টি
এসে আমাকে অনেক দোয়া করলো।
সিমির দিকে তখন তাকানো
যাচ্ছিলো না। সিমিকে বলে,
অ্যান্টিকে সালাম করে শেষ মাসের
টাকার খামটা হাতে নিয়ে আমি
বেড়িয়ে পরলাম। নিজেরও খুব খারাপ
লাগছে। এই কয়েকদিনে মানুষগুলোর,
অ্যান্টির হাতের চায়ের, সিমির শত
প্রশ্নের ঝুড়ির অনেকটা মায়ায় পরে
গেছি। তবুও কিছু মনে করছিনা, কারণ
মায়া খুব খারাপ জিনিস, নিজেকে
যত্ন করে কষ্ট দেওয়ার জন্যে অন্যের
প্রতি মায়াই যথেষ্ট।
.
হাটতে হাটতে বাসায় চলে আসলাম।
ম্যাচের সব দেনাপাওনা মিটিয়ে
দিলাম। ব্যাগ গুছিয়ে, গোসল করে,
দুপুরের খাবার খেয়ে বেড়িয়ে
পরলাম বাড়ির উদ্দেশে ম্যাচ থেকে।
দু'হাতে দুইটি ব্যাগ আর পিছনে একটা।
জিনিসপত্র বলতে যা আছে সবকিছুই
এরমধ্য গোছানো। ম্যাচ থেকে
বেড়িয়েই দেখলাম সামনে রিকশা
দাঁড় করিয়ে সিমি দাঁড়িয়ে আছে।
দেখে কিছুটা অবাক হয়ে গেলাম।
এখানে এইসময় সিমির থাকার কথা নয়।
এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাস করলাম---
-- কি ব্যাপার তুমি এখানে?
-- হ্যা আপনার জন্যেই অপেক্ষা করছি!
মা আপনাকে জলদি আমার সাথে
যেতে বলেছে। আর আপনার ফোন বন্ধ
কেন?
-- ফোন বিক্রি করে দিয়েছি, আর
আমিতো এখন বাড়ি যাচ্ছি। এখন
কিভাবে যাবো!
-- হ্যা বাড়ি অবশ্যই যাবেন, তার আগে
একটু আমাদের বাসায় চলেন।
.
ব্যাগ রাখার জন্যে আবার ম্যাচের
দিকে হাটবো এমন সময় সিমি বললো---
-- আরে আরে যাচ্ছেন কোথায়?
-- ব্যাগটা রেখে আসি,
-- রাখা লাগবেনা, ব্যাগ নিয়েই
চলেন।
.
কথাটা বলেই সিমি একটা ব্যাগ ধরে
রিকশায় তুললো। বাকি ব্যাগ দুটো
আমি নিজেই রাখলাম। সিমি অপর
পাশে গিয়ে রিকশায় উঠে বসে,
আমাকেও উঠে বসতে বললো। আমি
চলে আসলাম সিমিদের বাসায়। একটা
ব্যাগ নিয়ে সিমি সামনে সামনে
চলে গেল। রিকশা ভাড়াটা আজ
আমিই দিলাম। ব্যাগ নিয়ে বাসায়
ঢুকতেই অ্যান্টি বললো---
-- কি বোকা ছেলে, আমাকে সব খুলে
বললে কি এমন হতো!
.
অ্যান্টির কথাটা আমি বুঝতে পারলাম
না। অ্যান্টি সিমিকে বললো---
-- চাবি নিয়ে যা, ওকে ওর রুমে দিয়ে
আয়!
.
হতভম্ব হয়ে শুধু তাদের চলাফেরা আর
কর্মকাণ্ড দেখছি যাচ্ছি। সিমি চাবি
আর আমার ব্যাগটা হাতে নিয়ে
বললো---
-- আসুন,
-- কোথায়?
-- আগে আসুন তারপর বলছি।
.
ব্যাগ নিয়ে সিমির পিছুপিছু উঠতে
উঠতে ৫ তলা ছাড়িয়ে ছাদে গিয়ে
পৌঁছাইলাম। খেয়াল করলাম সিমি
চিলেকোঠার রুমটা খুলছে। আমাকে
ডাকলো---
-- ব্যাগ নিয়ে ভেতরে আসুন স্যার,
.
ভেতরে গিয়ে দেখলাম সাজানো
গোছানে খুব পরিপাটি একটি রুম।
সিমি আমাকে বললো---
-- আজ থেকে এইটা আপনার রুম, আপনি
এখানে থাকবেন। আর সময় মতো
আমাদের বাসায় গিয়ে খেয়ে
আসবেন। ছাদে কিছু ব্রেঞ্চ এনে
দিবো আর আশেপাশের কিছু
ছাত্রছাত্রী এনে দিবো তাদের
পড়াবেন এখানে।
.
সবটুকুই চাওয়ার বাইরে পাওয়া। কিছুটা
স্বপ্নের মতোও লাগছে। সিমিকে
বললাম---
-- এতকিছু আমার জন্যে কেন?
-- সেটা আপনার না জানলেও চলবে,
-- অ্যান্টিকে আমার চলে যাওয়ার
কারণটা বলেছিলে?
-- হ্যা,
-- কেন?
-- কারণ আমি আপনাকে আর কোথাও
যেতে দেব না।
.
কথাটা বলেই সিমি মাথানিচু করে
রইলো। কথায় কথায় মুখ ফোসকে
অনিচ্ছায় কথাটা বেড়িয়ে পরেছে।
আমি সিমির এমন কথাশুনে হেসে
উঠলাম। সিমি বললো---
-- হাসছেন কেন?
.
আমি হাসতে হাসতেই সিমিকে
বললাম---
-- কি বললে আরেকটাবার বলো!
.
সিমি লজ্জায় দৌড়ে নিচে চলে
গেল। আর আমি সেখানেই দাঁড়িয়ে
বারবার ভাবতে লাগলাম পাগলি
মেয়েটা কথা। (কারণ আমি আপনাকে
আর কোথাও যেতে দেব না)
.
এভাবেই শুরু হলো একটি চিলেকোঠার
ভালবাসার গল্প। প্রকৃতপক্ষে আপনি এখন
এই গল্পের শেষে দাঁড়িয়ে।
Comments
Post a Comment