"সত্যেরও ভাগ থাকে"


"সত্যেরও ভাগ থাকে"

(একটা গল্প মানেই, একটা শিক্ষা)
.
-- কি ব্যাপার মনমরা হয়ে বসে আছো কেন?
-- মনটা যে মরে গেছে!
-- তুমি কি আবার সিগারেট খাওয়া শুরু করেছো?
-- কই না, নাতো।
-- তাহলে টেবিলের নিচে থেকে কিসের ধোঁয়া উঠছে?
.
মিনার সাহেব হাত দিয়ে ধোঁয়া সরানের বৃথা চেষ্টা করলো। শার্মিলী বেগম (মিনার সাহেবের স্ত্রী)আহত স্বরে বললো---
-- তুমি কি কোনদিন আর শুধরাবে না?
.
মিনার মাথানিচু করে রইলো। আর শার্মিলী দুচোখের জল ছেড়ে দিয়ে জমানো কষ্টের কথাগুলো কান্না জড়িত কণ্ঠে বলতে শুরু করলো---
-- আসলে তুমি ব্যর্থ নও, ব্যর্থ হলাম আমি! দীর্ঘ ৭ বছর একসাথে একছাদের নিচে থেকে একবিছানায় ঘুমিয়েও তোমার ভালবাসা পাবার যোগ্য হয়ে উঠতে পারিনি। যে মানুষটি তোমাকে ঠকিয়ে কষ্টদিয়ে জীবন থেকে চলে গেছে। তাকে ভেবেই সারাজীবন আমাকে পোড়ালে। অথচ আমার কি দুর্ভাগ্য, তোমার সব জেনেশুনে এতটা ভালবাসলাম তার কোন মূল্যই পেলামনা! আমি বলে তোমার সংসার করে গেলাম। এই স্থানটাতে যদি অন্যকেউ থাকতো তাহলে বুঝতে কতটা কঠিন হয় জীবন।
.
কথাগুলো বলতে বলতেই কান্নার শব্দে রুমের বাকি শব্দগুলো স্তব্ধ হয়ে গেছে। পাশের রুম থেকে তিন্নি (মিনার শার্মিলীর ৫ বছরের একমাত্র মেয়ে)এসে মাকে জড়িয়ে ধরে কাপড়ের কুঁচকির মাঝে মাথা ঠেকিয়ে বললো---
-- আম্মু তুমি কাঁদছো কেন? আম্মু, আম্মু তুমি কাঁদছো কেন? পাপা কি তোমায় মেরেছে আম্মু?
.
তিন্নি মায়ের কাছে কোন প্রশ্নের উত্তর না পেয়ে বাবার কাছে দৌড়ে গিয়ে জানতে চাইলো---
-- পাপা, তুমি কি আম্মুকে মেরেছ? আম্মু কাঁদছে কেন?
.
মিনার মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কলে তুলে নিয়ে চুমু দিয়ে বললো---
-- না মা,
-- তাহলে আম্মু কাঁদছে কেন?
-- তোমার দাদুর কথা খুব মনে পরেছে তো তাই। চল আমরা বাইরে খেলতে যাব।
.
মিনার মেয়েকে নিয়ে বাইরে চলে গেল। আর এদিকে শার্মিলী বেশকিছু সময় সেখানেই দাঁড়িয়ে থেকে রান্নাঘরে চলে গেল।
রান্নাবান্না শেষ করে দুপুরের খাবার খাওয়ার জন্যে খাবার টেবিলে অপেক্ষা করছে শার্মিলী। বিয়ের পর মিনার-কে ছাড়া শার্মিলী কখনো একমুঠো অন্ন হাতে নিয়েছে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ আছে। তবে হ্যা মিনার যখন অফিসের কাজে বাসায় ফিরেনি, যখন অফিসের কাজে দূরে কোথাও দুতিন দিনের জন্যে ঢাকার বাইরে চলে গেছে। তখন শুধু শার্মিলী মিনার-কে ছাড়া খাবারের টেবিলে বসেছে। তবে এর মাঝেও একটা কিন্তু আছে! যতক্ষণ না মিনার খেয়েছে ফোন করে জানতে পেরেছে, ততক্ষণ পর্যন্ত তার পেটে কিছু পরেনি। কপালজোরে এমন স্ত্রী মেলে একজন পুরুষের জীবনে। তবে এতকিছুর পরেও যখন সে অবহেলিত হয়, মনযোগাতে ব্যর্থ হয় তখন খোদার দেওয়া মনজমিন কেঁপে উঠে।
.
ক্ষণিকের সময় বাদে মিনার মেয়েকে নিয়ে বাসায় ফিরলো। তিন্নি দৌড়ে খাবারের টেবিলে গিয়ে মায়ের পাশের চেয়ারটায় বসলো। মিনারও হাতমুখ ধুয়ে এসে খাবারের টেবিলে বসলো। শার্মিলী প্লেটে ভাত বেড়ে দিয়ে মিনারের সামনে দিলো। লালশাক আর বাতাসি মাছের ঝোল চড়চড়ি রান্না হয়েছে। দুটোই মিনারের সবচাইতে পছন্দের খাবার। এমন রান্না দেখে তার আর দেরি সইলোনা। কব্জি ডুবিয়ে খেতে লাগলো মিনার। এরমাঝে থেকেথেকে রান্নার প্রশংসা করেই যাচ্ছে মিনার। তবে শার্মিলীর কোনো প্রতিউত্তর নেই। মিনারও বুঝে গেছে আজকের অভিমানটা বড্ড বেশি হয়ে গেছে। তখন আর কোনকিছু বললোনা মিনার। ছুটির দিনে দুপুরে একটু না ঘুমালেই নয়। মিনার খাওয়াদাওয়া শেষ করে বিছানায় গিয়ে একপাশ ঘুরে শুয়ে পরলো। শার্মিলী মেয়েকে নিয়ে গিয়ে টেলিভিশন চালু দিয়ে বিছানায় গিয়ে পা দুলিয়ে বসলো। পাশে তিন্নিও তার মতোই বসে আছে। শার্মিলী মিনারের এমন বিভোর ঘুম দেখে রেগে টেলিভিশনের সাউন্ড বাড়িয়ে দিলো। বিকট শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল মিনারের। পিছন পাশে ঘুরে তাকিয়ে দেখলো মা মেয়ে সর্বচ্চ বলিউম দিয়ে টেলিভিশন দেখছে। ঘুমঘুম গলায় মিনার বললো---
-- এতো বলিউম দিয়ে টেলিভিশন দেখতে হয়!
.
কোনো সাড়াশব্দ আসলোনা মা মেয়ের কাছে থেকে। মিনার শুয়ে শুয়ে টেলিভিশনের শব্দের সাথে ভাবতে লাগলো এই পাগলি বউটার কথা। কতটা ভালবাসে মেয়েটা। অথচ আমিই নানা কারণেঅকারণে কষ্ট দিয়ে যাই। কি অদ্ভুত ভাবতেই অবাক লাগে, যখন একটু শান্ত হয়ে বসে থাকি তখনি ভাবতে শুরু করে আমি বুঝি সেই মেয়েটিকেই শুধু ভাবি! বেশি ভালবাসলে সন্দেহ থাকে জানতাম। তাই বলে এতোটা সন্দেহ থাকে ভাবতেও পারিনি। আমিও যদি অবুঝ হয়ে কথাবার্তা বলতাম তাহলে হয়তো আজ এই অব্দি সম্পর্কটা কখনোই আসতোনা। ভাগ্যিস সেটা বুঝতে পারি "সন্দেহের চেয়েও প্রখর ভালবাসা"। আসলে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে গেলে প্রতিটি সসন্দেহজনক ব্যক্তিরই বোঝা উচিত। ভালবাসে বলেই সন্দেহ করে, ভালবাসে বলেই অভিমান, গালমন্দ, বকাঝকা করে। ভালবাসে বলেই নিজের অধিকারের উপর ভর দিয়ে রাখে।
.
মিনারের ভাবনার ঘোর শেষ হলো। পাগলি বউয়ের নীরবতা সহ্য করা অনেক কঠিন। তাছাড়া প্রিয় মানুষের সুন্দর মুখটা গোমরা করে থাকলে মনে হয় পুরো পৃথিবীটার মন খারাপ। না এভাবে আর নয়। মিনার শার্মিলীর অভিমান ভাঙানোর জন্যে প্রস্তুত হলো। তিন্নি কে বললো---
-- মা তোমার বেবিডলটা কোথায়?
.
তিন্নি এইবার উত্তর দিলো---
-- বেবিডল তো ঐ রুমে রেখে এসেছি,
-- তোমার বেবিডলটা মনে হয় কান্না করছে। যাও মক ঐটাকে ঘুমপাড়িয়ে দিয়ে এসো।
.
তিন্নি খাট থেকে নেমে দৌড়ে পাশের রুমে চলে গেল বেবিডলটাকে ঘুম পারাতে। মিনার শুয়ে থেকেই আস্তে করে শার্মিলীর হাত চেপে ধরে কাছে টেনে নিলো। হৃদয়ের প্রতিটি স্পন্দনবেগ আজও জানানি দিচ্ছে ভালবাসার কথা। আর সেটা মিনার ঢের টের পাচ্ছে। চোখের মাঝে নিজের প্রতিচ্ছবি দেখাটার মাঝে ভিন্ন একটা ভাললাগা লুকিয়ে থাকে যা কেবল চোখ থেকে চোখের দূরত্ব ৯ ইঞ্চি হলেই দেখতে পারে মিনার। শার্মিলীকে দুহাতে বেষ্টিত করে মিনার বললো---
-- এতো সন্দেহ কেন?
-- সত্য বললেই সেটা সন্দেহ তাইনা?
-- সত্যটা কি জানো?
-- হ্যা জানি,
-- কি?
-- তুমি ঐ মেয়েকে আজও ভুলতে পারনি।
-- তারপর?
-- তারপর আর কি! ঐ মেয়েকে ভেবে ভেবেই তুমি সিগারেট খাও!
-- তারপর?
-- তুমি আমাকে একটুও বুঝোনা,
.
শেষের কথাটা শুনে মিনার শার্মিলীর কপালে আদরের সবচেয়ে বড় চুমুটা দিলো। আর বললো---
-- আমি সেই মেয়েটিকে ভালবেসেছিলাম সেটা সত্য। এখন তোমাকে ভালবাসি সেটা তার চেয়েও বড় সত্য। আর তার থেকেও চরম সত্য তুমি আর তিন্নি ছাড়া আমার ভাবনায় আজ আর কেউ নেই।
-- হয়েছে হয়েছে তোমার আর মনভোলানো কথা শুনাতে হবেনা। আমি এমনিতেই পটে আছি।
-- হা হা হা,
.
মিনারের হাসি দেখে শার্মিলী তার আলতো ঠোঁটে মিনারের ঠোঁট ছুঁয়ে দিলো। সাথে মিনারের হাসিটাও স্তব্ধ হয়ে গেল। কিছুটা সময়ের জন্য স্তব্ধ প্রকাশ করলো সমস্ত রুম। বিশ্বাসটা গরম নিশ্বাস পেলে আরও দৃঢ় হয়, আরও উল্লাসিত উদ্ভাসিত হয় জীবন। জীবনের দোটানায় জীবন থমকে দাঁড়ায় ঠিকি। অচেনা অজানা মানুষ আপন হয়ে ঘরে আসে। পিছনে ফেলে আসে শতশত স্মৃতি। সে স্মৃতি নিয়ে কখনো বিবাদ করতে নেই। কোন মনমালিন্য করতে নেই। সেটা মিনার শার্মিলী দুজনেই জানা। জানা, সত্যের চেয়েও কিছু সত্য থাকে। সেগুলোকে সবার প্রথম প্রাধান্য দেওয়া উচিত। জীবন তার জীবনের গতিতে চলবে। জীবনের হিসাব জীবন কষবে। কেউ সেই হিসেব মিলাতে সক্ষম নয়। কেবল কিছু আন্দাজ, অনুমান করে নিজেরাই নিজেদের জীবনটাকে কঠিন করে তুলি। আবার কখনো সহজ করে তুলি ইচ্ছাসুখ বিলিয়ে দিয়ে। যে ভালবাসে, যারা ভালবাসে তাদের মাঝে নিজেকে বিলিয়ে দিলে ভালো থাকার চেষ্টা করতে হয়না। বরং তারাই ভালো রাখার জন্য সারাদিন সারারাত চেষ্টা চালাতে থাকে।

Comments

Popular posts from this blog

গল্প: বউ বউ লাগছে

বউয়ের মাইর

একটা বাস্তব জীবন কাহিনী